প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় হলো কীভাবে?
উত্তর : সে অনেক আগে, পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে। আমার নানা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসায়। তিনি কলকাতার পাট চুকিয়ে ঢাকা চলে এসেছেন। আমি তার বাসায় থাকতাম। তখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা, আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী। দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে খাজা নাজিমুদ্দিন ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
প্রশ্ন :ষাটের দশকে এসে তো আপনি দুই অর্থনীতির তত্ত্ব দিলেন এবং সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবার যোগাযোগ।
উত্তর :ষাটের দশকের শুরুতে আমি পাকিস্তানের টু-ইকোনমি নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ ব্যাপারে কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এমন এক সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলাম। ওইদিনই প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাস করলো যে পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি রয়েছে কি-না। পরদিন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে পাশাপাশি দুটি সংবাদই ছাপা হয়। 'পাকিস্তানে টু-ইকোনমি: রেহমান সোবহান। পাকিস্তানে ওয়ান ইকোনমি :প্রেসিডেন্ট আইয়ুব। এর ফলে বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে তোলপাড় শুরু হয়। ষাটের দশকের শুরুর ঘটনা এটা। এই সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে খবর পাঠান দেখা করার জন্য। দেখা হয় একটি বাসায়, যেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বিস্মিত করে বলেন, টু-ইকোনমি নিয়ে আমার সব লেখাই তিনি পড়েছেন। কয়েক বছর আগে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসায় তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সেটাও তিনি উল্লেখ করলেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ।
প্রশ্ন :পরবর্তী সময়ে আপনারা দু'জন আরও ঘনিষ্ঠভাবে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন, আমরা জানি। আপনি অর্থনীতিবিদ। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কেমন দেখেছিলেন?
উত্তর :এক কথায় অসাধারণ। কর্মজীবনে আমি কম মানুষের সংস্পর্শে আসিনি। কাজও করেছি অনেকের সঙ্গে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এমন বাস্তববাদী রাজনীতিক আমি আর দেখিনি। যে কোনো পরিস্থিতি তিনি অনন্যসাধারণ দক্ষতায় মোকাবিলা করতে পারতেন। তার আগে ওই বিষয় সম্পর্কে খুঁটিনাটি বুঝতে চাইতেন। আমার মনে আছে, সত্তরের নির্বাচনের পর যখন ছয় দফা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হলো, তখন তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করতেন আমাদের সঙ্গে। তাজউদ্দীন আহমদসহ দলের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের নিয়ে আমাদের সঙ্গে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, মাঝে দুপুরের খাবার বিরতি। ছয় দফার প্রতিটি পয়েন্টে আলোচনা হতো। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে কী কী বাধা আসবে, সেসব তিনি জানতে চাইতেন একডেমিশিয়ানদের কাছে। তবে কোনো ইস্যুর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্ধী, এক-দুই সেকেন্ডেই ধরতে পারতেন।
প্রশ্ন: সেখানে রাজনীতিকদের বাইরে আরও কে কে থাকতেন?
উত্তর: আমি ছাড়াও অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান ও মোশাররফ হোসেন থাকতেন। শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদ ও মোজাফফর আহমদ চৌধুরী থাকতেন। সত্তরের নির্বাচনের আগে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে। তখন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তখন তারও প্রখর মেধার পরিচয় পেয়েছি।
প্রশ্ন :সত্তরের নির্বাচনের আগে তিনি কি আপনাদের আভাস দিয়েছিলেন- ওই নির্বাচন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তর হতে যাচ্ছে?
উত্তর :ঘরোয়া আলোচনায় আমার মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর কাছে বিষয়টি পরিস্কার ছিল। তিনি সবদিক প্রস্তুত না হয়ে কোনো কাজে নেমে পড়তেন না। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালেও এটা দেখেছি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য যদি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে যেতে হতে পারে। তখন সাধারণ ভোটার ছাড়াও শ্রমিক-ছাত্র-পেশাজীবী-মধ্যবিত্তের মধ্য থেকে রাজপথে সমর্থন প্রয়োজন পড়বে। সত্তরের নির্বাচনে তিনি এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি চেয়েছেন জনসমর্থন ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের মুখোমুখি হতে। বারবার বলতেন, আগে নির্বাচন হতে দিন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এলএফও বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করেছিলেন, যাতে সংবিধান চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, নির্বাচন হোক। জনগণই বলে দেবে- ক্ষমতা কার হাতে।
প্রশ্ন :তার সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ?
উত্তর :বঙ্গবন্ধু রাত-দিন সংগঠন শক্তিশালী করার কথা ভাবতেন। জনগণের কাছে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। তার সহকর্মীরা ক্লান্ত হতো, তিনি হতেন না হেঁটে চলেছেন; রিকশা, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে চেপেছেন। তার নিজের কথা আছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' গ্রন্থে। কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হয়, কীভাবে দলের তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ রাখতে হয়; তা জানা যায় এ দুটি গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধু দলীয় শৃঙ্খলা অসম্ভব আস্থা রাখতেন। তিনি মনে করতেন, বড় কোনো আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক শৃঙ্খলা গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধ এবং ন্যায়-নীতির প্রতি আনুগত্য থাকতেই হবে।
প্রশ্ন :সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
উত্তর :অনেক স্মৃতি। আমি তার সঙ্গে দেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন সময়ে এগুলো বলেছি, লিখেছি। ওই নির্বাচনে তাজউদ্দীন সাহেব আহমদুল কবিরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেনন। বঙ্গবন্ধু ঘোড়াশালের একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। সঙ্গে আমরা অনেকে যাচ্ছি। আদমজীনগর থেকে নৌকা নিয়ে আমরা ঘোড়াশাল যাব। বামপন্থিরা বলত, বঙ্গবন্ধু ব্যবসায়ী পক্ষের মানুষ। শ্রমিকরা তার সঙ্গে নেই। কিন্তু আদমজীনগরে গিয়ে দেখেছিলাম হাজার হাজার শ্রমিক। তারা বলছে, বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতে রাজি। নৌকায় করে যখন ঘোড়াশাল যাচ্ছিলাম, নদীর দুই পাশে দেখি মানুষ আর মানুষ। গোটা দেশেই তার সমান জনপ্রিয়তা আর কোনো নেতার ছিল না। অন্য নেতারা যখন নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছে, তখন তিনি অন্য প্রার্থীদের জয়ী করে আনতে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তখন একটা কথা চালু ছিল- বঙ্গবন্ধু কোনো আসনে একবার সফর করলে নৌকার ভোট ৫০ হাজার বেড়ে যায়।
প্রশ্ন :আপনার সর্বসাম্প্রতিক একটি বই 'ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশনস :মাই জার্নি টু বাংলাদেশ'। এখানে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব নিয়ে একটি মজার গল্প বলেছেন। পাঠকের জন্য আরেকবার বলবেন?
উত্তর :আপনি সম্ভবত 'শেখ মুজিবউদ্দিন' প্রসঙ্গটি বলছেন। সত্য-মিথ্যা জানি না। গল্পটি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কুষ্টিয়ায় এক প্রার্থী প্রত্যন্ত গ্রামে ভোট চাইতে গেলে তাকে ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দেয় গ্রামবাসী। তারা জানায়- বিপক্ষ প্রার্থীকে ভোট দেবে না তারা। তখন সেই প্রার্থী চমকে গিয়ে প্রশ্ন করেন- গ্রামবাসী তাহলে কাকে ভোট দেবে? উত্তর আসে- 'আমরা শেখ মুজিবউদ্দিনকে ভোট দেব।' ওই আসনে শেখ মুজিবউদ্দিন নামে কোনো প্রার্থী ছিলেন না। গ্রামবাসীর কথার মানে হলো, শেখ মুজিব যাকে প্রার্থী করবেন, তাকেই গ্রামবাসী ভোট দেবে।
প্রশ্ন :এটা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্য। রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের প্রতি কেমন ছিলেন?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, পক্ষ-বিপক্ষ সবার সঙ্গে তিনি অমায়িক ও ভদ্র ব্যবহার করতেন। আমার একটা স্মৃতি আছে। মওলানা ভাসানী আর পাকিস্তানের মিয়া ইফতেখার উদ্দিন মিলে ন্যাপ তৈরি করেছিলেন। ওই দল গঠনের দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের মারপিট হয়েছিল। মিয়া ইফতেখার উদ্দিন ভিড়ের মধ্যে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি যখন শাহবাগ হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন আমি তাকে দেখতে যাই। ঠিক একই সময়ে বঙ্গবন্ধুও এসেছিলেন। আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধু এসে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, পলিটিক্স ইজ পলিটিক্স। তার বিরোধী রাজনীতি যারা করতেন তাদের সঙ্গেও তিনি সৌজন্য দেখাতে কার্পণ্য করতেন না।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্যের কারণ কী ছিল?
উত্তর :আপনাকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে অনেক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের জুনিয়ার হয়েও এক পর্যায়ে সামনে চলে এসেছেন রাজনৈতিক দূরদর্শীতা দিয়ে। প্রকৃত অর্থে বাঙালির জাতীয় পরিচয়ের প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন তিনি। আপনি ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন, ছয় দফা কর্মসূচি পেশের পর থেকে তিনি কেবলই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর জোর দিয়ে গেছেন। তিনি ক্রমাগত বুঝিয়ে গেছেন বাঙালিরা আলাদা। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে প্রচারাভিযান পর্যন্ত সময়ে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রচলিত আওয়ামী লীগার ছাড়াও দলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশ ঘটাতে পেরেছিলেন। দলের বাইরে তিনি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে, যাদের কেউ সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করতো নিঃস্বার্থভাবে।
প্রশ্ন :ওই নির্বাচনের পর তো এলো মুক্তিযুদ্ধ। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি পরিচালিত হচ্ছিল।
উত্তর :তিনি ছিলেন যেন বাংলাদেশের অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। তখনও ইয়াহিয়া সরকার ছিল, কিন্তু একাত্তরের পয়লা মার্চ থেকেই পূর্ববাংলা কার্যত স্বাধীন ছিল। এর পরিচালনার ভার ও কর্তৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তিনি নিজে এই ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, জনগণই তার হাতে অর্পণ করেছিল। তার চারপাশে সমবেত হয়েছিল গোটা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলায় যুক্ত বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার বাঙালি সদস্যরাও তাকে সহায়তা দিয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত সরকারি রেডিও, টেলিভিশন তার পাশে থেকেছে। সংবাদপত্র তো ছিলই। তারা সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছে। অনেক দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু কোথাও জাতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত হওয়ার আগেই এমনভাবে আনুগত্য বদল হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ কার্যত একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়।
প্রশ্ন :অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বিশেষত্ব কী ছিল? ভেতর থেকে কীভাবে দেখেছেন?
উত্তর :আমার মনে হয়, অর্থনীতি একটি বড় বিবেচনা ছিল তার কাছে। বঙ্গবন্ধু অর্থনীতির কথা কখনও ভুলতেন না। তিনি মনে করতেন, এতে করে নিম্নবিত্ত মানুষের অসহায়ত্ব বাড়ে। অসহযোগ আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক। এ ভূখণ্ডে অর্থনীতি ও অবকাঠামো প্রায় অচল হয়ে পড়ে। ঠিক এ পর্যায়েই বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সত্তেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উদ্যোগী হন। এর রাজনৈতিক তাৎপর্যও আপনাকে মনে রাখতে হবে। এভাবে একই সঙ্গে আন্দোলন এবং অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রহণ করায় অসহযোগ আন্দোলন পরিণত হয় স্ব-শাসনে।
প্রশ্ন: অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে গৃহীত হতো?
উত্তর: তখন অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আওয়ামী লীগের অধীনেই নীতিনির্ধারণী সংস্থা গঠিত হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম, রপ্তানি বাণিজ্য, সরকারি কর্মীদের বেতন প্রদান, রাজস্ব আদায়, কৃষিজমির জন্য সার বিতরণ, রেল ও সড়ক পরিবহন চালু- এ ধরনের আরও অনেক রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি ছোট সেল গঠন করা হয়। এর সদস্যরা প্রতিদিন নিজেরা আলোচনা করতেন এবং ব্যাংকার, আমলাসহ আরও অনেকের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক যেসব বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, সেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করা হতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে তার ব্যক্তিগত বাসভবনে। এসব পদক্ষেপ ও উদ্যোগের মধ্যেও অর্থনীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন বা চিন্তাধারা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর :বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। তিনি ওই ধারাতেই স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি সমবায় পদ্ধতির কট্টর সমর্থক ছিলেন। তিনি চাইতেন, দেশে ছোট-বড় অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হোক। তিনি কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন তিনি সমানভাবে চাইতেন। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চাইতেন। অনেকটা জওহরলাল নেহরুর মতো।
প্রশ্ন :আপনি দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। তার উন্নয়ন দর্শন সম্পর্কে আমাদের আরেকটু বলুন।
উত্তর :এটা আমার জন্য একটি বড় অভিজ্ঞতার বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমি পাকিস্তানের মতো ধনিক শ্রেণি তৈরি করতে চাই না। তিনি সারাজীবন পাকিস্তানের ২২ পরিবার তৈরির বিরুদ্ধে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বললেন, এদেশে আর যাই হোক, ২২ পরিবার তৈরি হবে না। তিনি দেশের মানুষের হাঁড়ির খবর জানতেন। ঢাকায় বসেও জানতেন কোন জেলার কী সমস্যা। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন হবে বঞ্চিত মানুষের জন্য। তিনি যে দুঃখী মানুষের কথা বলতেন সব সময়, তাদের উন্নয়ন চাইতেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমি বঞ্চিত মানুষের জন্য সমাজ তৈরি করব। এটা আমার দায়িত্ব। বাংলাদেশে নতুন একটা এলিট শ্রেণি বঙ্গবন্ধু চাইতেন না। তিনি চাইতেন, তার দুখি মানুষের মুখে হাসি ফুটুক সবার আগে।
প্রশ্ন :তিনি তো আসলে জননেতা ছিলেন।
উত্তর :জনগণের ওপরেই ছিল বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা। কীভাবে তাদের কাছে সবচেয়ে ভালোভাবে পৌঁছানো যায়, সেটা তিনি জানতেন। যে কারও সঙ্গে কথা বলে, এমনকি প্রতিপক্ষের লোক হলেও তাকে মুগ্ধ করতে জানতেন। এমনও দেখেছি যে, তার সম্পর্কে সর্বক্ষণ বিরূপ মন্তব্য করছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার সমর্থকে পরিণত হয়েছেন। এমন গুণ বিরল। আমার ধারনা তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মানুষের ভেতরটা দেখতে পেতেন।
প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখার কথা মনে পড়ে?
উত্তর :অবশ্যই মনে পড়ে। আমি পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে বিআইডিএসে যোগ দিয়েছিলাম। ফলে তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো না। এ সময়েই বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যু হয়। আমি ও আমার স্ত্রী সালমা সোবহান তার বাসায় যাই সমবেদনা জানাতে। তিনি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হলেও তার বাসায় লোকজনের যাতায়াতে কোনো সমস্যা ছিল না। যাওয়ার পথে গাড়িতে স্ত্রীকে বলি যে, অনেক দিন দেখা না হওয়ার প্রসঙ্গটি বঙ্গবন্ধু তুলতেও পারেন। তিনি ভাবতে পারেন যে, তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলছি। গিয়ে দেখি আরও অনেকে সেখানে। তিনি বাবার স্মৃতিচারণ করছিলেন। বললেন, অতি সাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে চলতে বলতেন। কোনো ভালো কাজে বাধা দিতেন না। মানুষকে সম্মান দিতে বলতেন। বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, রাজনীতি থেকে তারা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এতে উভয় পক্ষের ক্ষতি হয়। আমার মনে হচ্ছিল, আমাকে উদ্দেশ করেই এসব বলছেন। হঠাৎ কাছে এসে বললেন, আপনি মনে করছেন যে দূরে সরে থাকতে পারবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কাছে আসতেই হবে। এমনভাবে কথা বললেন, যেন আমি গাড়িতে আসার সময় স্ত্রীকে যা যা বলেছি, সব তিনি শুনেছেন।
প্রশ্ন :এমন একজন নেতাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম কেন?
উত্তর :এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। বঙ্গবন্ধুর একটি দুর্বলতা ছিল- সবাইকে সমান বিশ্বাস করতেন। মানুষের ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। প্রত্যেকের শক্তি-দুর্বলতা সহজেই ধরে ফেলতে পারতেন। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তারা দেশের জন্য কাজ করেছেন, দলের জন্য কাজ করেছেন। যে যেটুকু করেছে তার জন্য সম্মান দিতে, স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। এ কারণে কিছু সমস্যাও তৈরি হতো। কেউ মন্দ কাজ করলে, ভুল পথে চললে কঠোর হতে পারতেন না। তার চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠত বাঙালির অধিকার আদায়ের দিনগুলোতে ওই ব্যক্তির অবদানের কথা। তিনি মনে করতেন, কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারবে না। এমন ধারনার মূলে ছিল মানুষের প্রতি এই বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিল।

বিষয় : বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা

মন্তব্য করুন