অবশেষে ত্রিপুরাপল্লীতে বিদ্যুৎ
রোগশোক ভুলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ওরা
সারোয়ার সুমন ও জাহাঙ্গীর আলম, হাটহাজারী থেকে
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৯:৩৮ | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ০৩:৫৩
হাটহাজারীর কাটিরহাট থেকে ছয় কিলোমিটার ইটবিছানো রাস্তার পর প্রায় এক হাজার
২০০ ফুট দীর্ঘ কাদামাটির রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় ত্রিপুরাপল্লীতে। রাস্তাটি
কর্দমাক্ত হলেও এর দু'পাশে আমন ধানের কচি চারা তৈরি করেছে সবুজের
শামিয়ানা। দুর্গাচরণের স্ত্রী গুণলক্ষ্মীর দেখা মিলল রাস্তার পাশের এ
জমিতে। গুনগুন করে গান গাইছেন তিনি আর তাতে সুর মেলাচ্ছেন নিশি রানী, চম্পা
ত্রিপুরা ও রীতা ত্রিপুরা। মুখে গান থাকলেও হাত দিয়ে ধানগাছের চারা থেকে
আগাছা পরিস্কার করছিলেন তারা। হাম ও পুষ্টিহীনতায় চার শিশুসন্তানকে হারানোর
শোক সামলে ওঠার চেষ্টায় গুণলক্ষ্মীরা। আবার ত্রিপুরাপল্লী থেকে অবহেলার
স্মৃতিও মুছতে দেখা গেছে প্রশাসনকে। এতদিন বিদ্যুৎহীন থাকলেও হরিমন ও মকর
চানের ঘরে বিদ্যুতের মিটার লাগাতে দেখা গেছে পল্লী বিদ্যুতের লোকজনকে। আবার
পল্লীর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে স্বাস্থ্যসম্মত ২৬টি ল্যাট্রিন বসাতে দেখা
গেছে উপজেলা প্রশাসনের লোকজনকে। হঠাৎ এক শোকে থমকে যাওয়া ত্রিপুরাপল্লীর
বাসিন্দারা ফের নেমেছে জীবনযুদ্ধে। রোগশোক ভুলে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তারা।
ত্রিপুরাপাড়ার সর্দার তাকিধন ত্রিপুরা বললেন, 'জীয়ন আর আচুই তুংইয়া। ওহনি
থানোই তামমাতানু।' যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়- 'জীবন তো আর থেমে থাকে না।
পেটের তাগিদে কাজ করতে হয়।' তাকিধনের পাশেই ছিলেন চন্দন ত্রিপুরা।
স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসাতে তার সহায়তা নিচ্ছে প্রশাসন। খুঁটিসহ শ্রমিক
সরবরাহের কাজ করছেন চন্দন। ত্রিপুরাপল্লীর পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বললেন,
সমকাল পত্রিকার কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। তারা যদি আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা এভাবে
তুলে না ধরতেন, তাহলে হয়তো এখনও অন্ধকার থাকত এ পল্লী।
ত্রিপুরাপল্লীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎহীনতা নিয়ে টানা চার দিন
প্রতিবেদন করেছে সমকাল। এখানকার বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর
সমকালের শিরোনাম ছিল- 'শতভাগ বিদ্যুতায়িত হাটহাজারী :বিদ্যুৎ নেই শুধু
ত্রিপুরাপাড়ায়।' এ সংবাদ প্রকাশের পর স্থানীয় এমপি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ,
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা আক্তার উননেছা শিউলি ও পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম সাদেক জামান
ত্রিপুরাপল্লীর সব ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। উপজেলার উন্নয়ন তহবিল
থেকে এক লাখ ৩৯ হাজার টাকা খরচ করে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হয় ২২টি ঘরে।
আরও আটটি ঘরে টানা হয়েছে বিদ্যুতের লাইন। এগুলোতে মিটার বসানো হলে
ত্রিপুরাপল্লীর প্রতিটি ঘরেই জ্বলবে আলো।
এদিকে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন বসাতেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা
প্রশাসন। ৫৫টি পরিবারের জন্য ২৬টি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন বসাচ্ছে তারা।
গতকাল পর্যন্ত ১৮টি ল্যাট্রিন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। প্রতি দুটি পরিবারের
জন্য দেওয়া হচ্ছে একটি করে ল্যাট্রিন। আবার ত্রিপুরাপল্লীর পানীয়জলের
সমস্যা দূর করতে বসানো হয়েছে দুটি টিউবওয়েল। এর একটি সাধারণ ও আরেকটি গভীর
নলকূপ। সাধারণ নলকূপটি বসিয়েছেন সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ও জেলা পরিষদের
চেয়ারম্যান এমএ সালাম। গভীর নলকূপটি বসানো হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, অবহেলিত
ত্রিপুরাপল্লীর জীবনমান উন্নয়নে সব রকমের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে
তাদের বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। বসানো হয়েছে পর্যাপ্ত টিউবওয়েল ও স্যানিটারি
ল্যাট্রিন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে আনতে আরও প্রকল্পের দরকার হলে সেটিও
গ্রহণ করবে প্রশাসন।
স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তার উননেছা শিউলি বলেন, সরকারি ফি
দিয়ে বিদ্যুৎ নেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না ৩০টি পরিবারের। তাই ২২টি পরিবারকে
মিটার, তারসহ যাবতীয় সরঞ্জাম কিনে দিয়ে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিয়েছি আমরা।
বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেছি আরও আটটি ঘরে। উপজেলার উন্নয়ন তহবিল
থেকে এ জন্য এখন পর্যন্ত এক লাখ ৩৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
জানা গেছে, ত্রিপুরাপল্লীতে পুষ্টিহীনতা ও হামে আক্রান্ত হয়ে যে ২৫ শিশু
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তারা সবাই এখন সুস্থ আছে। এ জন্য হাসপাতাল থেকে
ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তাদের সবাইকে। শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক
করতে সেখানে গণশিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করারও চিন্তা করছে প্রশাসন। রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে পুরো
পাড়াকে। আগে কোনো টিকা না দিলেও সোনাইপাড়ার দুই শতাধিক শিশুকে নতুন করে
দেওয়া হয়েছে টিকা।
এ প্রসঙ্গে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবু সৈয়দ মোহাম্মদ
ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে
তাদের সবাই সুস্থ হয়ে ওঠায় বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য
কার্যক্রম আরও জোরদার করতেও সংশ্নিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২৮ বছর বয়সী দুর্গাচরণ ত্রিপুরা বলেন, চার শিশুসন্তান মারা যাওয়া ও ২৫ জন
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রশাসনের নজর পড়ে অবহেলিত এ পাড়ায়। তাই বেশ কিছু
উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। গত ১৫ দিনে আমরা যা পেয়েছি তা স্বাধীনতার ৪৭
বছরেও পাইনি। ৫০ বছর বয়সী ধর্মচরণ ত্রিপুরা বলেন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে
আবার শুরু করেছি জীবনসংগ্রাম। দিনের বেলা পাহাড়ে যাই। সেখান থেকে যে কাঠ
পাই তা বিক্রি করে চালাচ্ছি সংসার। আমার স্ত্রীও কাজ করে জমিতে। দু'জনের আয়
দিয়ে দুই শিশুসন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর স্বপ্ন দেখছি আমরা।
- বিষয় :
- বিদ্যুৎ